Hridoy Choya Koster Bangla Golpo Ep – 4. হৃদয় ছোয়া কষ্টের বাংলা গল্প পর্ব -৪।
ছাত্রকে পড়াতে পড়াতে একটু রাত হয়ে গেলো।ছাত্রের মাকে যখন যখন বললাম- ভাবী, কাউকে দিয়ে আমাকে একটু গলির মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দিতে পারবেন? আসলে এই গলিতে কিছু বখাটে ছেলেরা বসে আড্ডা দেয়, তাই যেতে একটু ভয় লাগে।
আমার কথা শুনে ছাত্রের মা হাসতে হাসতে বললো- তুমি ভয় পাও, নাকি তোমাকে দেখে গলির ছেলেগুলো উল্টা ভয় পায়?
কিছুটা অবাক হয়ে বললাম- মানে!
উনি হেসে বললো- না কিছু না! তোমার গায়ের রঙ যে পরিমাণ কালো, তুমি অন্ধকারে হাঁটলে তোমাকে তো কেউ দেখার কথা না!
ছাত্রীর মায়ের কথার ইঙ্গিতটা ঠিকই বুঝতে পারলাম। তাই কিছু না বলে চুপচাপ বাসা থেকে একাই বের হয়ে গেলাম!
মাঝে-মধ্যে সৃষ্টিকর্তারকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে- হে খোদা, মানুষ রুপে যেহেতু পাঠিয়েছো, তাহলে গায়ের রঙটা একটু ফর্সা বানিয়ে পাঠালে কি এমন ক্ষতি হতো? মানুষের এতো লাঞ্চনা আর সহ্য হয় না!
রাতে যখন খাবার খাচ্ছিলাম, তখন মা কিছুটা ভয়ে ভয়ে বাবাকে বললো- কাল যে ছেলেটা রিতাকে দেখতে আসবে, শুনেছি সেই ছেলেটা নাকি আগেও একটা বিয়ে করেছিলো?
বাবা খেতে খেতে কর্কশ গলায় বললেন- হুম করেছিলো বিয়ে!
-সেই সংসারে নাকি ৬ বছরের একটা সন্তানও আছে?
-হুম আছে!
-জেনে-শুনে এমন একটা ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে আমাদের উচিত হবে?
বাবা প্লেটটা দূরে সরিয়ে মায়ের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললো- তোমার মেয়ের জন্য এমন ছেলে পছন্দ করবো না তো রাজকুমার পছন্দ করবো? কে তোমার এই মেয়েকে বিয়ে করতে চাইবে শুনি? মেয়ে পেটে থাকাকালীন কি কয়লা খেতে যে এমন একটা মেয়ে জন্ম দিয়েছো!
একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো, লুলা, ল্যাংড়া,কানা যে-ই মেয়েকে পছন্দ করবে, আমি তার সাথেই মেয়েকে বিয়ে দিবো। কোনরকম দায়মুক্ত হতে পারলেই বাঁচি।
বাবার কথা শুনে মায়ের চোখের জল ফেলা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। আর নিজের চোখের জলের কথা বাদেই দিলাম…
পরদিন পাত্রপক্ষ যখন আমাকে দেখতে আসলো, তখন মা নিজ হাতে আমাকে সাজিয়ে দিচ্ছিল। বাবা তড়িঘড়ি করে রুমে ঢুকে মাকে বললো- যেভাবে পারো মেকাপ-টেকাপ দিয়ে হলেও মেয়েকে সাজিয়ে দাও। মেয়েকে কোন রকম পছন্দ করলেই বাঁচি।
এই মুহুর্তে নিজেকে মানুষ না, সজিয়ে-গুজিয়ে কোরবানির হাটে তোলা গরু মনে হচ্ছিলো। গরুকে সুন্দর করে সাজালে ক্রেতাদের যেমন আকর্ষণ বাড়ে, তেমনি আমাকে সাজানো হচ্ছে যেন ছেলে পক্ষ পছন্দ করে।
ছেলে পক্ষ আমাকে দেখে খুব একটা পছন্দ করলো না। বাবার কাছে অনেক টাকা যৌতুক চাইলো, যৌতুকের বিনিময়ে বিয়ে হবে!
পাত্রপক্ষ চলে যাবার পর বাবা আমার কাছে এসে বললো- বাজারে তো বিষ পাওয়া যায় নাকি? খেয়ে মরে যেতে পারিস না?
আমি কিছু না বলে শুধু পাথরের মতো বসে রইলাম —
সৃষ্টিকর্তা বান্দাকে একদিকে অপূর্ণ রাখলে, অন্যদিকে পূর্ণতা বাড়িয়ে দেন। দেখতে অসুন্দর হলেও পড়াশোনায় মোটামুটি ভালোই ছিলাম।
নিজ কানে আশেপাশের মানুষ ছাড়াও, জন্মদাতা বাবার অনেক আপমানসূচক কথা শুনেছি, নিজ চোখে মাকে নিরবে চোখের জল ফেলতে দেখেছি!
নিজেও চোখের জল ফেলেছি, আর পড়াশোনায় মনোযোগ দিয়েছি। বছর খানেক পর আমি সফলও হয়েছি। আজ আমি উর্দ্ধতন সরকারী কর্মকতা।
একদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখি, ছাত্রের মা এসেছে তার ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে!
এটা শুনে মুচকি হেসে উনাকে বললাম- ভাবী, আপনার ভাই আমাকে অন্ধকারে খুঁজে পাবে তো? আমাকে দেখে কি ভয় পাবে না? যা হোক, বাসায় যখন এসেছেন চা-নাস্তা খেয়ে চলে যান। কথাগুলো শুনে উনি কিছু না বলে মাথা নিঁচু করে চলে গেলো…
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, যে পাত্র আমাকে যৌতুকের বিনিময়ে বিয়ে করতে চেয়েছিল। সে পাত্র বাসায় এসে হাজির।
বাবাকে বলছে সে কোন কিছু চায় না, শুধু আমাকে বিয়ে করতে চায়। বাবা কিছু বলার আগেই আমি ছেলের দিকে তাকিয়ে বললাম- ঠিক আছে, আমি বিয়ে করতে রাজি। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে, আমি বিয়ের পর চাকরি করবো না!
আমার কথা শুনে ছেলেটা অবাক হয়ে বললো- কেন, চাকরি করলে সমস্যা কি?
আমি তখন বললাম- আমি বিয়ের পর শুধু সংসারে মন দিবো। স্বামীর সেবা-যত্ন করবো, বাইরে চাকরি-বাকরি করতে পারবো না!
ছেলেটা অবাক হয়ে বললো- এতো বড় চাকরিটা না করলে তো হবে না!
রাগী চোখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললাম- বাইরে যাওয়ার দরজাটা ওই দিকে, তুই আর এক মিনিটও দাঁড়ালে থাপ্পড় মেরে তোর সবকটা দাঁত ফেলে দিবো! ছেলেটা কিছুটা ভয় পেয়েই বাসা থেকে দ্রুত পায়ে বের হয়ে গেলো।
বাবা আমার কাছে এসে বললো- তুই কি বিয়ে করবি না?
আমি বললাম- অবশ্যই বিয়ে করবো, যদি কোন ছেলে আমাকে চামড়া দেখে বিবেচনা না করে, আমার চাকরির প্রতি লোভ না করে, তাকেই বিয়ে করবো।
-কিন্তু মা…
বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম- বাবা, আমি দেখতে কালো হই আর যেমন-ই হই না কেন, আমি তো তোমারই মেয়ে!
মানলাম বাবা হিসেবে আমাকে নিয়ে তোমার টেনশন হতো এবং হওয়াটা স্বাভাবিকও। তবুও তুমি কি করে পারতে, নিজের মেয়েকে এতোটা কষ্ট দিয়ে কথা বলতে?
বাবা, সৌন্দর্য্য বা শারীরিক গঠন মানুষের হাতে থাকে না, তবুও ঘরে-বাইরে সব জায়গায় প্রতিনিয়ত অপমানিত হয়েছি।
বাবা কালো মানুষের শরীর থেকে কি পঁচা গন্ধ বের হয় নাকি যে, ওদের দেখলে সভ্য সমাজের মানুষ নাক ছিঁটকায়?
আমার কথা শুনে বাবা যখন চুপ করে রইলো, আর আমি বাবার সামনে থেকে নিজ রুমে চলে গেলাম। জানি, বাবা কান্না করবে। করলে করুক, তবুও বাবা যদি আমার কষ্টটা একটু উপলব্ধি করতে পারে…