Hridoy Choya Koster Bangla Golpo Ep – 3. হৃদয় ছোয়া কষ্টের বাংলা গল্প পর্ব -৩।
বাসায় ঢুকেই বুঝতে পারি আজকে বাসায় বড় ধরনের কিছু হয়েছে। মা আর স্বর্ণার রুম বন্ধ। শিমুল ডাইনিং টেবিলে বসে ছবি আঁকছে।
: কি খবর শিমুল বাবা?
শিমুল ফিসফিস করে বলে, খবর ভালো না। আজকের লুডু খেলায় দাদী হেরে গেছে।
: তারপর ?
: তারপর মা সে খবর ফেসবুকে জানিয়ে দিছে। ফুপি দাদীকে ফোন করেছিলো। তারপর হতেই দাদীর রুম বন্ধ। মা অনেক ডাকাডাকি করছে। কিন্তু দাদী দরজা খুলে নাই। এরপর হতে মা’র রুমের দরজাও বন্ধ।
: ওহ্!!
আমি পরপর তিনবার ডাক দেয়ার পর মা দরজা খুলে বের হয়ে এলেন।
: কি ব্যাপার মা! অফিস থেকে আসার পর যদি বাসার এই অবস্থা দেখি, তাহলে কি ভালো লাগে?
: আমাকেই তোর চোখে পড়লো? তোর বউ যে দরজা বন্ধ করে আছে তাকে তো কিছু বললি না!!
: আমার কাছে মা’র চেয়ে বড় কিছু নাই। তাই মা’কে ডেকেছি। আগে বলো, দরজা বন্ধ করে আছো কেন ?
: দরজা বন্ধ করে কাপড়-চোপড় গুছালাম। এখানে আর থাকবো না, মুক্তার বাসায় চলে যাবো।
: কেন কি হয়েছে ?
: আমি জানি তোর আদরের ছোট বাপে তোকে সব বলে দিয়েছে। তারপরও আমাকে আবার প্রশ্ন করছিস কেন? দেখ পলাশ, তোর ছেলে আমার সাথে ঘুমায়, প্রতিদিন তিন-চারটা গল্প বলে তাকে আমি ঘুম পাড়িয়ে দেই। আমার শরীরের উপর পা উঠিয়ে না দিলে তার ঘুম আসে না। সে আমার এতো কাছের একজন মানুষ। অথচ তার চোখের সামনে তার মা নয়-ছয় করে আমাকে হারিয়ে দিলো। কিন্তু সে কোন প্রতিবাদ করে নাই। আর একটা কথা, আচ্ছা আমি হেরেছি ভালো কথা, কিন্তু সেই কথা আবার মোবাইলে জানাতে হবে কেন? মুক্তা আমাকে ফোন করে কতো হাসি-তামাশা করলো। আমার কেউ থাকলে কিন্তু তোর বউ এমনটা করতে পারতো না !!
শিমুল গোল গোল চোখে তার দাদীর দিকে তাঁকিয়ে আছে। লাগাতার অভিযোগ শুনার পর সে ছোট ছোট পায়ে তার দাদীর দিকে এগিয়ে যেতে চায়। দাদী চোখ-মুখ কুঁচকিয়ে শিমুলকে উদ্দেশ্য করে বলে,
: খবরদার আপনি আমার কাছে আসবেন না। আপনি আজকে থেকে আপনার আম্মাজানের সাথে ঘুমাবেন। আমি একটু পরে আপনার কাঁথা-বালিশ দিয়ে আসবো।
শিমুল মাথা নীচু করে থাকে।
এবারই কিন্তু প্রথম নয়। মা আর স্বর্ণার মধ্যে এমনটা হরহামেশাই ঘটে থাকে। আর এসব ঘটনার রেশ থাকে সর্বোচ্চ আটচল্লিশ ঘন্টা। তারপর সব স্বাভাবিক। এভাবেই চলছে আমাদের সংসার জীবন।
আমি সংসারটাকে মধ্যবিত্ত স্তরে থিতু রাখার জন্য পরিশ্রম করে যাচ্ছি। মাঝে মধ্যে ঠেকে যাই। তখন মা পাশে এসে দাঁড়ায়। মা’র একান্ত নিজের একটা ফান্ড আছে। নানা আর বাবা মিলে সে ফান্ড তৈরি করে দিয়েছিলো। প্রত্যেক মাসের শুরুতে মা ব্যাংক থেকে লভ্যাংশ তুলে আনে। তারপর তিনি শিমুলের মৌলিক প্রয়োজন অনুযায়ী হাত খুলে খরচ করেন। তাঁর আরও একটা খরচের খাত আছে, তা হচ্ছে মুক্তা আর ওর দুই সন্তান। মুক্তা যখন ওর দুই সন্তান নিয়ে এ বাডিতে আসে তখন মায়ের মুখের দিকে তাঁকালে মনে হয় তিনি হচ্ছেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।
মা আমাকে যখন টাকা দেয় তখন হাসতে হাসতে বলেন, আমি কিন্তু এ টাকা তোকে ধার হিসেবে দিচ্ছি। কিন্তু সে ধার আর কখনোই শোধ করা হয়না। প্রকৃতপক্ষে মা আমাকে সে সুযোগ দেয়না। তিনি বলেন, জমতে থাকুক একসাথে ফেরত নিবো।
স্বর্ণার শিক্ষা আছে, জ্ঞান আছে, ধৈর্য্য আছে আর সবচেয়ে বেশী আছে সবকিছুতে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা। শৈশবে মা হারানো স্বর্ণার কাছে এ সংসারে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ হচ্ছে মা। কিন্তু সে কোনভাবেই তা বুঝতে দিবেনা। তার মূল কাজ হচ্ছে কারনে-অকারণে মায়ের সাথে খুনসুটি করা। আর কোনভাবে যদি লুডু খেলায় মাকে হারাতে পারে তবে তো কথাই নেই। সারা বাড়ি ঘুরবে আর মিটমিট করে হাসবে। আর তা দেখে মা রাগে ফুলতে থাকবে ।
এদিকে আমি আর শিমুল বেচারা এই চক্র স্রোতে পড়ে হাবুডুবু খেতে থাকি।
হঠাৎ করেই মার শরীরটা খারাপ হয়ে যায়। রক্তচাপ আর ডায়াবেটিক অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে।
একদিন রাতে খাবার টেবিলে মা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলেন,
: আমি তোর কাছে কত টাকা পাই ?
: আমি তো হিসাব করে রাখিনি মা !!
: যাই হোক তোর কাছে কী গচ্ছিত কোন টাকা-পয়সা আছে?
: লাখ তিনেক টাকার মতো আছে। কেন ?
: আগামি মাসের শুরুতে ওখান থেকে আমাকে দুই লাখ টাকা দিবি। আর তোকে একদিন ছুটি নিতে হবে। কোনদিন ছুটি নিতে হবে আমি তোকে ঠিক এক সপ্তাহ আগে জানাবো।
আমি বাতাস বোঝার জন্য স্বর্ণার দিকে তাঁকাই। স্বর্ণা ঠোঁট উল্টিয়ে বুঝিয়ে দিলো সে কিছু জানেনা। আমি তল খুঁজে পাইনা।
২.
এরমধ্যেও তারা লুডু নিয়ে বসে। আমি বাসায় আসার পর একেকদিন একেকজন অভিযোগের পসরা নিয়ে আমার সামনে দাঁড়ায়।
আমার মুখ থেকে শুধু একটাই কথা বের হয়, আল্লাহ তোমাদের কী দিয়া বানাইছে!!!
মাসের শুরুতেই আমি মায়ের হাতে দুই লাখ তুলে দেই। তিনি টাকাটা রেখে বলেন,
: তোর কী অনেক কষ্ট হলো?
: কী যে বলো মা! আমার তো মনে হয়ে তুমি আমার কাছে এরচেয়ে বেশী টাকা পাবে।
: আচ্ছা, ঢাকা-সিঙ্গাপুরের বিমান ভাড়া কত রে?
: কেন?
: তোর ছোট বাপকে নিয়ে বেড়াতে যাবো!! তোর বাপে তো কোনদিন হানিমুন করায়নি। তাই দুধের স্বাধ ঘোলে মিটাবো!
: মা তুমি আসলেই ………।
: আমার শরীরটা আসলেই খারাপ হয়ে গেলরে। স্বর্ণার সাথে ঝগডা করেও আর ঠিক রাখতে পারছিনা। আগামি রবিবার তোকে ছুটি নিতে হবে। শিমুলকে নিয়ে তুই বাসায় থাকবি। আমি স্বর্ণাকে নিয়ে একটু বাইরে যাবো। তোর স্বর্ণার কিছু বলার দরকার নেই। আমি ওর সাথে কথা বলে নিবো ।
নির্ধারিত দিনে মা স্বর্ণাকে নিয়ে বের হয়ে গেল। তারপর ঠিক দুপুরে ওরা ফিরে এলো। মাকে দেখে নির্ভার মনে হলেও স্বর্ণার মুখের দিকে তাঁকানো যাচ্ছে না। আমি বুঝতে পারি স্বর্ণা আমাকে এড়িয়ে চলছে। অত:পর আমরা খাবার টেবিলে বসি।
: মা, তোমরা কী বাইরে গিয়েও ঝগড়া করেছ?
: কেন ? তোর বউয়ের কালো মুখ দেখে কী তাই মনে হচ্ছে?
: হুম !
: আসলে তার শত্রু চিরদিনের মতো বিদায় হয়ে যাচ্ছে তো, তাই অতি আনন্দে তার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
: বুঝি নাই !
: বুঝিয়ে বললেই বুঝতে পারবি। আমি কিন্তু জানি সকল প্রকার যোগ্যতা থাকা সত্বেও স্বর্ণা কেবলমাত্র আমার কথা চিন্তা করে চাকরিতে যায়নি। যেটা ঠিক হয়নি। কেননা টাকার একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে যা মানুষকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করবার ফুসরত দেয়। আমার কাছে কিছু টাকা ছিলো বলেই কিন্তু আমি তোর প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াতে পেরেছি। এই পাশে দাঁড়ানোর ক্ষমতাটা একজন নারীর জন্য যে কত আনন্দের তা তুই চিন্তাও করতে পারবি না। আমার বয়স হয়েছে। তাই আজকে আমি তোর দুই লাখ টাকাসহ আমার সব টাকা স্বর্ণাকে বুঝিয়ে দিয়েছি। ইচ্ছে ছিলো মুক্তাকে কিছু দিবো, কিন্তু মুক্তা আমাদের প্রত্যাশার চাইতেও ভালো আছে। তবে, তোর বউ যদি বাসা থেকে বের করে দেয় তাহলে কিন্তু আমাকে না খেয়ে মরতে হবে। আমার কাছে তো আর একটা টাকাও নেই।
ওদিকে, স্বর্ণার চোখের কোল উপচে নোনতা জলের ধারা বৃষ্টির মতো ভাতের উপরে পড়ছে। মা উঠে গিয়ে স্বর্ণার নুয়ে পডা মাথাটা তাঁর বুকের সাথে মিলিয়ে নিয়ে বলে,
আজকে আমার ছেলে বাসায় আছে দেখি কে আমাকে নয়-ছয় করে হারায়!!