Hridoy Choya Koster Bangla Golpo Ep – 2. হৃদয় ছোয়া কষ্টের বাংলা গল্প পর্ব -২।
Hridoy Choya Koster Bangla Golpo Ep – 2. হৃদয় ছোয়া কষ্টের বাংলা গল্প পর্ব -২।
আমার স্বামী যখন মারা যায়, তখন আমার একমাত্র মেয়ে রোদেলার বয়স আট বছর । ক্লাস থ্রিতে পড়ে। আমার স্বামী ডা. তৌফিক, মেডিসিন কনসালটেন্ট ছিল । তখন বছর খানেক হলো প্রমোশন হয়েছে । রোজ মোটর সাইকেলে করে উপজেলাতে যেতো। একদিন হাসপাতালে যাওয়ার পথেই এক্সিডেন্ট করলো। তাকে নিকটবর্তী হাসপাতালে নেওয়া হলো । কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ ।
যেদিন প্রমোশনের খবরটা পেয়েছিল, সেদিন তৌফিক, রোদেলার জন্য একটা সুন্দর সোনার চেইন কিনে এনেছিল। সেদিন তৌফিক এর খুশি যেনো আকাশ ছোঁয়া ছিল । বারবার বলছিল, ” নীতু, আমাদের আর কোন কষ্ট থাকবে না দেখো। এবার প্রাকটিসটা ভালো জমবে । তোমাদের সব সাধ আহলাদ পূরণ করতে পারবো।” রোদেলাকে মাঝে মাঝেই বলতো, ” প্রিন্সেস, যাও তো, চেইনটা পরে এসে বাবাকে দেখাও।” মেয়ে যেনো এটা শোনার অপেক্ষাতেই থাকতো। পরে এসে বাবাকে দেখাতো। তারপর চলতো বাবা মেয়ের গল্প গুজব ।
প্রাকটিসটা ধীরে ধীরে আসলেই জমছিল। আমার ভাসুর ছোট খাটো ব্যবসায় লস খেয়ে বাসায় বসেছিল । তাকে টাকা দিয়ে, বড়সড় একটা ব্যবসা ধরিয়ে দিলো। আমাদের চাহিদাগুলোও আস্তে আস্তে সব পূরণ হচ্ছিলো । এর ভিতরেই এই দূর্ঘটনা ।
স্বামীর শোকের সাথে সাথে দুশ্চিন্তাও দিন দিন বাড়তে থাকলো। আমরা মা মেয়ে খাবো কি? কোথায় থাকবো ? মাথা গোজবার মত একটা বাড়ি, তখনও আমরা তৈরি করতে পারিনি। আমি মাস্টার্স পাশ করেছি, পাঁচ বছর আগে । চাকরি করার কথা কখনো মাথায় আসেনি । মনের আনন্দে সংসার করেছি । বাবা মারা গিয়েছে, বছর দুয়েক আগে । ভাইদের সংসারে মা ই বোঝা; সেখানে আমি যাবো কেমনে?
অনেক ভেবে চিন্তে শ্বশুর বাড়িতে যাবো বলে ঠিক করলাম । প্রথম প্রথম সবাই ভালো ব্যবহারই করলো। আমার ভাসুরের তখন ব্যবসার অবস্থা ভালো । হয়তো কৃতজ্ঞতা বোধ তখনও ছিল । তাই রোদেলার পড়াশুনার খরচ এবং প্রয়োজনীয় হাত খরচ না দিলেও, থাকা, খাওয়ার সমস্যা হচ্ছিলো না। বাসার কাজ কর্ম আমি নিজে থেকেই করতাম । তফাৎ শুধু, আগে নিজে থেকে করতে চাইলেও করতে দিতো না । এখন কিছু বলে না । আসলে তখনকার কথা আলাদা । তখন চার পাঁচ দিনের জন্য বেড়াতে আসতাম। মেহমানকে তো আর কেউ কাজ করতে দেয় না । এখন আমি বাড়ির মানুষ । কাজতো কিছু করা লাগবেই।
রোদেলার পড়ালেখার খরচের জন্য, বাসার ফার্নিচার গুলো এক এক করে বিক্রি করে দিলাম পানির দরে। তা যাক, ও গুলোতো বাড়িতেই আছে । আমার ভাসুর বিপদে যে ও গুলো কিনতে রাজি হয়েছেন, সেটাই বড় কথা । আমি তাতেই কৃতজ্ঞ । শুধু আগের মত রোদেলা যখন তখন ফ্রিজটা খুলতে পারে না । ওর চাচী বিরক্ত হয়। আচ্ছা বিরক্ত তো হবেই । তারা বাচ্চাগুলোর জন্য ফল ফলারি কিনে রাখে । সেটা যদি রোদেলা দেখে, খেতে চায়! আমি রোদেলা কে ভালো মত বুঝিয়ে দিয়েছি, এ বাড়ির কোন জিনিসে যেন হাত না দেয়। আমার মেয়ে লক্ষ্মী মেয়ের মত সেগুলো শোনে।
ফার্নিচার গুলো শেষ হওয়ার পরে, অলংকারগুলো ধরলাম । তাও একসময়ে শেষ হলো। এরপর লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে রোদেলার চাচীর কাছে কিছু টাকা ধার চাইলাম। উনি বললেন, ” গহনা বেচে দাও। ওগুলো জমিয়ে রেখে কি করবা ?” আমি অবাক হয়ে বললাম, ” সব গহনা তো তোমার কাছে বেচে দিয়েছি ভাবী!” ভাবী আরো বেশি অবাক হয়ে বললো, ” অভাবে মানুষের স্বভাব এভাবে নষ্ট হয়, তাতো জানতাম না !!! তোমাকে সারাজীবন সৎ এবং স্পষ্টবাদী জানতাম । এখন দেখি, নিজের গহনা লুকিয়ে রেখে, অন্যের টাকা মারার ধান্দা । ” আমার চোখে পানি চলে আসলো । বললাম, ” বিশ্বাস করো ভাবী, আর কোন গহনা নেই। ” ভাবী চটে যেয়ে বললো, ” কাঁদছো কেন ? আমি তোমাকে কি বলেছি ? এজন্য মানুষের উপকার করতে হয় না । রোদেলার সুন্দর একটা সোনার চেইন আছে না ?”
আমি অবাক হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললাম । ওটা আমার তৌফিক এর একমাত্র স্মৃতি রোদেলার জন্য । আমি অবাক হয়ে বললাম, ” ভাবী !!! ” ভাবী তেজ দেখিয়ে চলে গেল । বিকালে ভাবীর হাতে চেইনটা দিয়ে বললাম, ” নাও ভাবী। এটা বিক্রি না করলে, রোদেলার ক্লাস সেভেনের ভর্তি ফিস দিতে পারবো না ।”
ভাবী চেইনটা গলায় দিয়ে খুব তৃপ্তির হাসি হাসলো। বললো, ” এত সুন্দর ডিজাইন এখানে পাওয়া যায় না । চেইনটা সব সময় পরে থাকার জন্য খুব সুন্দর ।”
পরের দিন রোদেলার নজরে পড়লো, তার চেইনটা চাচীর গলায়। সে চিৎকার দিয়ে উঠলো। বললো, ” এটা আমার চেইন, তুমি কেন পরেছো চাচী? ” ওর চাচী হেসে দিয়ে বললো, ” এখন থেকে এটা আমার চেইন। আমি কিনে নিয়েছি। ” রোদেলা অবাক হয়ে বারবার বলতে লাগলো, ” এটা আমার চেইন। মা, এটা আমার চেইন। আমার বাবা আমাকে দিয়েছে। ” আমি বললাম, ” মা, আমি এটা বিক্রি করে দিয়েছি । তুমি বড় হলে, আবার কিনে দেবো।” কিন্তু রোদেলা কিছুতেই শুনবে না । কান্নাকাটি জুরে দিলো। আমার শান্ত শিষ্ট মেয়েটা, হঠাৎ করেই যেন প্রতিবাদী হয়ে উঠলো। চাচীর কাছে যেয়ে চেইন ধরে টানাটানি করতে লাগলো, আর কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, ” দাও, চাচী দাও। এটা আমার বাবা আমাকে দিয়েছে। ” ওর চাচী রেগে যেয়ে বললো, ” যা এখান থেকে । ফকিরের বাচ্চা! “
আমি নিজেকে কনট্রোল করতে পারলাম না । জীবনে এই প্রথম ঠাস করে মেয়েটার মুখে একটা চড় মারলাম। আমার মেয়েটা কান্না থামিয়ে, অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো । পৃথিবীতে এত বড় বিস্ময়ের ব্যাপারও যে থাকতে পারে, ওর ধারণা ছিল না । যে মা, ওর গায়ে একটা পিপড়া কামড়ালেও, ওর আগে ওর মা কাঁদতো; সেই মা ওর মুখে চড় মেরেছে !!!! ব্যথা যেন শুধু মুখে নয়, ওর সমস্ত কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়েছে । রোদেলার মুখের দিকে আমি দ্বিতীয়বার তাকানোর সাহস পেলাম না । ঐ দৃষ্টি দ্বিতীয়বার সহ্য করার ক্ষমতা, স্রষ্টা আমাকে দেননি ।
দীর্ঘদিন পড়ালেখার অভ্যাস না থাকাতে, তেমন পড়তে পারতাম না । তবু শুরু থেকেই চাকরির চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম । শেষ পর্যন্ত সরকারি চাকরি না পেলেও একটা বেসরকারী হাই স্কুলের চাকরি পেয়ে গেলাম । রোদেলা তখন ক্লাস এইটে পড়ে। স্কুলের কাছাকাছি একটা ছোট বাসা নিলাম । রোদেলা কে আমার স্কুলেই ভর্তি করালাম। অনেক দিন পরে নিজেদের বাসা পেয়ে রোদেলা ভীষণ খুশি । মনে হলো, জান ফিরে পেয়েছে মেয়েটা। মনের আনন্দে পড়াশুনা করে, গান গায়, আমার সাথে খুনসুটি করে । আমাদের মা মেয়ের দিন চলে যায় কোন রকম ।
রোদেলা ওর বাবার মত জিনিয়াস হয়েছে। এস এস সি, এইচ এস সি, সব পরীক্ষাতেই ওর রেজাল্ট অসম্ভব ভালো । সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ থেকে এম বি বি এস পাশ করেছে। প্রথম বারেই বি সি এস হয়ে গেলো । নিজ এলাকাতেই পোস্টিং হয়েছে। প্রথম মাসের বেতন যেদিন পেলো, সেদিন ওর আনন্দ ছিল আকাশ ছোঁয়া । যেনো পৃথিবীটা জয় করে এসেছে। কনসালটেন্ট হিসাবে প্রমোশন পাওয়ার পর, তৌফিক যেমন খুশি হয়েছিল, ঠিক তেমন। বারবার আনন্দে চোখ ভিজে যাচ্ছিলো আমার ।
বাসায় এসে আমাকে জরিয়ে ধরে বললো, ” অনেক কষ্ট তুমি আমার জন্য করেছো মা । আর কষ্ট করতে দেবো না তোমাকে ।” বেতনটা আমার হাতে দিয়ে বললো, ” আমার প্রথম মাসের বেতন দিয়ে তোমার যা খুশি তাই কেনো। ” আমি বললাম, ” একটা জিনিস আমার কেনার খুব শখ। সামর্থ্য ছিল না বলে, কিনতে পারিনি । তোর পুরো বেতনটা ই লেগে যাবে, সেটা কিনতে গেলে । দিবি ? ” রোদেলা মহাখুশি। বললো, ” অবশ্যই মা। কি কিনবা ? ” আমি পুরোনো এলবামটা বের করে নিয়ে আসলাম। রোদেলার বাবার সাথে রোদেলার ছবি, যেটাতে রোদেলা সোনার চেইনটা পরে আছে । সেটা দেখিয়ে বললাম, ” এইটা। ”
রোদেলা খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । রোদেলার আজকের এই দৃষ্টিও সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি মাথা নিচু করে ফেললাম । যে গভীর ক্ষতটা তৈরি হয়েছিল বুকের ভিতরে, সে ক্ষত আমার মেয়ে দেখে ফেলে কষ্ট পাক, তা আমি চাই না ।