Shikkhamulok Bangla Golpo E-1. শিক্ষা মুলক বাংলা গল্প পর্ব -১।

 Shikkhamulok Bangla Golpo E-1. শিক্ষা মুলক বাংলা গল্প পর্ব -১।

Shikkhamulok Bangla Golpo E-1. শিক্ষা মুলক বাংলা গল্প পর্ব -১।

আমার স্ত্রী দেখতে কালো বলে আমার মা আগে থেকেই বলে রেখেছে আমার স্ত্রী ভুলেও যেন সকালে  আমার ছোট বোনের রুমে না যায়। আমার ছোট বোন ৭মাসের প্রেগন্যান্ট।মেয়ের যেন এই অবস্থায় কোন অযত্ন না হয় তাই মা ছোট বোনকে নিজের কাছে এনে রেখেছেন। 

সেদিন সকালে ছোট বোনের চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে গেলো। তড়িঘড়ি করে বোনের রুমে গেলাম। ভাবলাম বোনের আবার কোন সমস্যা হলো না কি। রুমে গিয়ে দেখি আমার ছোট বোন আমার স্ত্রীকে বলছে,

-”তোমাকে না বলেছি সকাল সকাল আমার রুমে না আসতে।সকালে ঘুম থেকে উঠে তোমার চেহাটা দেখলেই আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।”

আমি আমার ছোট বোনকে বললাম,

–তোর রুমে এসেছে বলে কি হয়েছ? তাছাড়া আমার বউয়ের চেহারার মাঝে কি এমন আছে যার জন্য তোর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়?

ছোটবোন কিছু না বলে চুপ হয়ে আছে। অন্য রুম থেকে তখন মা এসে বললো,

-” সকালে ঘুম থেকে উঠে অলক্ষ্মীর চেহারা দেখলে কার মেজাজ ভালো থাকে? আমার মেয়েটার কয়েকদিন পর বাচ্চা হবে। মেয়েদের বাচ্চা হবার আগে আগে যার চেহারা বেশি বেশি দেখবে বাচ্চা তার মতই হবে। আমি চাই না আমার মেয়ের সন্তান তোর বউয়ের মত হোক। দুনিয়ার সব মানুষ তো তোর মত বোকা না যে কালো চামড়ার মেয়ে বিয়ে করবে।”

আমি আমার মাকে কিছু না বলে বোনের দিকে তাকিয়ে বললাম,

–আমার মা না হয় সল্প শিক্ষিতা তাই এইসব কুসংস্কার বিশ্বাস করে।কিন্তু তুই তো ইন্টার পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিস। তোর কি এইসব জিনিস বিশ্বাস করতে হয়?

এই কথাটা বলে আমি যখন আমার রুমে আসলাম তখন আমার স্ত্রী আমার দিকে হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে বললো,

-”আজ দুপুরে কি রান্না করবো?”

ওর হাসিমাখা মুখটা দেখে আমি খুব অবাক হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ আগে যে মেয়েটাকে আমার মা বোন এতো অপমান করলো তারপরেও সেই মেয়েটার মুখে এখনো হাসিটা কিভাবে লেগে আছে! হয়তো অতি কষ্ট পেয়েই মিথ্যা হাসির অভিনয় করছে।

আমি আমার স্ত্রীর হাতটা ধরে বললাম,

–আমার মা বোনের কথায় খুব কষ্ট পেয়েছো তাই না?

আমার স্ত্রী হেসে বললো,

-” একদম না।এইসব কথাতে আমি অনেক আগে থেকেই অব্যস্ত”

আমি অবাক হয়ে বললাম,

–মানে!

আমার স্ত্রী তখন বললো, 

-” আপনাকে ছোট তিনটা ঘটনা বলি।  কলেজে পড়া অবস্থায় অন্য সবার মতো আমারও ইচ্ছে হতো সাজতে। তো পাহেলা ফাল্গুনের দিন আমিও সবার মতো  শাড়ি পরলাম। সবার মত আমিও সাজলাম।  বাহিরে বের হওয়ার জন্য যখন বাসা থেকে বের হলাম তখন পাশের বাসার আন্টি আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলেছিলো “যতই মেকাপ করো না কেন কালো কাক কখনো সাদা বক হতে পারে না!”

  সেদিনের পর আর কখনো সাজতে ইচ্ছে হয় নি কারণ কালো মেয়েদের সাজতে হয় না..

  একবার কয়েকজন বান্ধবী মিলে রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম। বান্ধবীরা যখন সমানে সেলফি তুলছিলো তখন আমিও চেয়েছিলাম সেলফি তুলতে।তখন এক বান্ধবী আমায় বলে বসলো,” তুই সেলফির ভিতর থাকলে পুরো সেলফিটাই নষ্ট হয়ে যাবে।” 

   এরপর আর কখনো সেলফি তোলার ইচ্ছে হয় নি। কারণ কালো মেয়েদের সেলফি তুলতে নেই…

দেখতে কালো বলে একের পর এক পাত্রপক্ষ যখন বিয়ের জন্য না করে দিচ্ছিলো তখন আমার নিজের মা বলেছিলো,” এই অলক্ষ্মী মেয়েকে জন্ম দিয়ে আমি ভুল করেছি। এই অলক্ষ্মী মেয়ে মরেও না।”

নিজের বাবা বলেছিলো,” এই কপালপুড়ি আমার চোখের সামনে যেন না আসে” 

যেখানে আমার নিজের জন্মদাত্রী মা আমায় অলক্ষ্মী বলতে পারে সেখানে পরের মা আমায় অলক্ষ্মী বললে কষ্ট লাগবে কেন? যেখানে আমার জন্মদাতা পিতা আমার মুখ দেখতে চায় না সেখানে তোমার বোন আমার মুখ দেখতে না চাইলে আমার তো তাতে কষ্ট পাওয়ার কথা না।”

কথাগুলো বলা শেষে আমার স্ত্রী ওর চোখের কোণে জমা থাকা জলটা মুছলো অথচ ওর মুখে তখনো হাসিটা লেগে আছে। আমি বুঝতে পারছিলাম এই হাসিটার ভিতর কতটা যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে। 

—–

 দেড়মাস পরের ঘটনা আমার বোনের শরীরের অবস্থা হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তার বলে এখনি সিজার করতে হবে তা না হলে পেটের বাচ্চার ক্ষতি হবে। ডাক্তার আমার বোনকে অপারেশন থিয়েডারে নিয়ে যাওয়ার আগে বললো তাড়াতাড়ি ও-নেগেটিভ রক্তের ব্যবস্থা করতে। আমরা আগে থেকে যে ডোনারের সাথে কথা বলে রেখেছিলাম তাকে যখন ফোন দেই রক্তের জন্য তখন সে বলে, আমরা কেন থাকে আগে ভাগে জানায় নি? সে এই মুহুর্তে ঢাকার বাহিরে আছে। আমরা সবাই যখন ও-নেগেটিভ রক্তের জন্য ছুটাছুটি করছিলাম সেটা আমার স্ত্রী জানতে পেরে বাসা থেকে আমায় ফোন দিয়ে বললো,রক্তের জন্য চিন্তা না কারতে কারণ ওর রক্তের গ্রুপ ও-নেগেটিভ। ও এখনি হাসপাতালে আসছে ।

আমি ফোন রেখে আমার মায়ের কাছে গেলাম। মা তখন আল্লাহকে ডাকছে আর কান্নাকাটি করছে।আমি মায়ের পাশে বসতে বসতে বললাম,

–মা, রক্ত দেওয়ার মানুষ পাওয়া গেছে কিন্তু  সমস্যা হলো লোকটা কালো। কালো মানুষের শরীর থেকে রক্ত নেওয়া কি উচিত হবে? পরে যদি বাচ্চা কালো হয়?

মা রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

-” রক্তের মধ্যে কালো মানুষ আর ফর্সা মানুষের ভেদাভেদ কি? ফর্সা মানুষের রক্ত যেমন লাল হয় তেমনি কালো মানুষের রক্তও লাল হয়। তাছাড়া কালো মানুষের শরীর থেকে রক্ত নিলে যে পেটের সন্তান কালো হবে এমন আজগবি কথা তোকে কে বলেছে?”

আমি আর কিছু না বলে চুপচাপ মায়ের সামনে থেকে চলে গেলাম।

পরদিন সকালে খেয়াল করি আমার মা আমার ভাগ্নীকে কোলে  নিয়ে বসে আছে। পাশের বেডে আমার বোন শুয়ে আছে। আমি হাসিমুখে আমার মাকে বললাম,

–আচ্ছা মা, রক্তে যদি ফর্সা কালোর কোন ভেদাভেদ না থাকে তাহলে চামড়াই কেন মা এতো ভেদাভেদ? কালো মানুষের রক্ত শরীরে নিতে সমস্যা নেই অথচ কালো মানুষের চেহারা দেখলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায় কেন?  মা কখনো চামড়া দেখে মানুষকে বিবেচনা করতে নেই বরং চামড়ার ভিতরে  থাকা মানুষটাকে দেখে বিবেচনা করতে হয়। তোমাদের এত অপমানের পরেও আমার স্ত্রী মনে একটুও রাগ পুষে রাখি নি বরং সময়ে নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে আমার বোনকে বাঁচিয়েছে। 

মা আমার কথা শুনে নিরব হয়ে আছে। আমি তখন পাশে শুয়ে থাকা ছোট বোনকে বললাম,

–যে মানুষটা তোর এত অপমান সহ্য করার পরেও তোকে বাঁচাতে সাহায্য করেছে তাকে সম্মান দিতে না পারলেও কখনো অপমান করিস না বোন।

হঠাৎ খেয়াল করি দরজার পাশে আমার স্ত্রী দাঁড়িয়ে। ছোটবোন আমার স্ত্রীকে দেখে বললো,

-” ভাবী, তুমি দূরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? কাছে এসে আমার মেয়েটাকে একটু কোলে নাও। আর শুনো আমার মেয়ের নাম কিন্তু তোমার ঠিক করে দিতে হবে।”

বাচ্চাকে কোলে নিবার সাথে সাথেই আমার স্ত্রী কেঁদে দিলো।আমার স্ত্রীর কান্না দেখে আমার মা আর বোনও  কেঁদে দিলো। মা মেয়েদের কান্নার আনন্দময় মিলন মেলায় আমি আর দাঁড়িয়ে না থেকে কেবিন থেকে বের হয়ে আসলাম। মনের অজান্তে একফোটা চোখের জল আমার চোখেও জমা হয়েছে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *